একজন প্রবাসীর কষ্টে ভরা জীবনের গল্প।

যেদিন বাবা ফোন করে জানালো আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে এই মাসের ১৫ তারিখে, তখন আমার মনটা একটু ভারী হয়ে গেল। আমি বড় ভাই হয়েও, বাবা-মা আমাকে কিছু না জানিয়েই ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। তবে সাথে সাথেই ভাবলাম, যেহেতু আমি দেশের বাইরে আছি, তাই হয়তো তারা আমার বিয়ের কথা চিন্তা করেনি। দেশে ফিরলে নিশ্চয়ই আমার বিয়ের কথাও ভাববে। ছোট ভাইকে ফোন করে বললাম, 

 

"তোর আর তোর হবু বউয়ের বিয়েতে যা যা লাগে, আমায় জানাস। আমি টাকা পাঠিয়ে দেব।"


ছোট ভাইয়ের বিয়ের জন্য আমি মেয়ের গহনার জন্য দুই লাখ টাকা পাঠালাম। কিন্তু এরপরও সে বললো, যেন আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠাই, কারণ ওর হবু বউয়ের নাকি সোনার টিকলি কেনার খুব শখ। আমি তখন আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠালাম।


এরপর লক্ষ্য করলাম, যখনই পরিবারের কেউ ফোন দিতো, তারা কখনোই প্রথমে জিজ্ঞেস করতো না আমি কেমন আছি। বরং, জিজ্ঞেস করতো কবে টাকা পাঠাবো, ওর এটা দরকার, তার ওটা দরকার। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু পরে ভাবলাম, আমি পরিবারের বড় ছেলে। তারা আমার কাছে চাইবে না তো কার কাছে চাইবে? পরিবারের লোকজন কষ্ট করে টাকা খরচ করে আমাকে বিদেশ পাঠিয়েছে। এখন যদি তাদের চাহিদা পূরণ না করি, সেটাই হবে অন্যায়। মা-বাবা, ভাই-বোন যখন যা চাইতো, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে।


প্রবাসে দীর্ঘ ৯ বছর কাটানোর পর একদিন বাবাকে ফোন করে বললাম,  

– "বাবা, আমি দেশে আসতে চাই।"  

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন,  

– "দেশে এসে কি করবি?"  

আমি বললাম,  

– "দেশেই কিছু একটা করবো। তোমাদের ছাড়া একা থাকতে আর ভালো লাগে না। তাছাড়া ছোট ভাই-বোনের বিয়েতে থাকতে পারিনি। খুব ইচ্ছে করছে ওদের দেখতে।"  

বাবা কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন,  

– "দেখতে ইচ্ছে হলে ভিডিও কলে দেখে নিস। তবুও দেশে আসার দরকার নেই। আমি এখন নতুন বাড়ি বানাচ্ছি, তুই আসলে টাকা পাঠাবে কে?"


বাবার এই কথায় নিজেকে মানুষ না, বরং টাকা বানানোর যন্ত্র মনে হচ্ছিল। লোকেরা ঠিকই বলে, প্রবাসীদের পরিবার শুধু তাদের টাকা কামানোর মেশিন হিসেবেই দেখে।


কিছুদিন পর, কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে দেশে চলে এলাম। ৯ বছর পর দেশে ফিরলাম, কিন্তু পরিবারে কেউ আনন্দ পেলো বলে মনে হলো না। বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরার বদলে দূরে বসে রইলেন। ছোট বোন রেগে বসে আছে, কেন ওর স্বামীর জন্য রোলেক্স ঘড়ি না এনে অন্য ঘড়ি এনেছি। আমি বললাম,  

– "যে ঘড়িটা এনেছি, সেটাও অনেক ভালো।"  

তবু সে ঘড়িটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে বললো,  

– "আমার স্বামী এটা নেবে না। তোমার ভালো ঘড়ি তোমার জন্য রাখো।"  

এটা দেখে খুব খারাপ লাগলো। অথচ ও যখন যা চেয়েছে, সবই আমি মিটিয়েছি।


ছোট ভাইও রাগ করেছে, কেন ওর বউয়ের জন্য আইফোন নিয়ে আসিনি। আমি বললাম,  

– "ভাই, আমার বেতনের চেয়ে আইফোনের দাম বেশি। তাছাড়া তোকে তো একটা আইফোন দিয়েছি।"  

তবুও সে রেগে গিয়ে বললো,  

– "তোমার কাছে কি এমন চেয়েছি যে দিতে পারলে না? আমার বউয়ের জন্য কিছু চাইনি।" 


এরপর বাবা আমাকে ডেকে বললেন,  

– "তুই বিদেশ যাবি কবে?"  

আমি মাথা নিচু করে বললাম,  

– "আর যাবো না। দেশে কিছু করতে চাই।"  

বাবা রেগে বললেন,  

– "দেশে থেকে কি করবি?"  

আমি বললাম,  

– "আমাদের ব্যবসাটা বড় করতে চাই।"  

ছোট ভাই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অবাক হয়ে বললো,  

– "কিসের ব্যবসা? দোকান তো আমার।"  

আমি বললাম,  

– "কিন্তু দোকান করতে টাকা তো আমি দিয়েছি।"  

ছোট ভাই সরাসরি অস্বীকার করে বললো, আমি কোনো টাকা দিইনি, আর তার দোকানে আমাকে বসতে হবে না।  


সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন বাবা বললেন,  

– "ও ঠিকই বলেছে, তুই তার দোকানে আর বসিস না। পারলে নিজের দোকান দে।"  

আমি নতুন করে ব্যবসা করতে চাইলে, বাবা সরাসরি বললেন, তার কাছে কোনো টাকা নেই। যে ৯ বছরে আমি এত টাকা পাঠিয়েছিলাম, তা নাকি খাওয়া-দাওয়ায় খরচ হয়ে গেছে। জমি-জমা সবই ভাই-বোনের নামে। আমার নামে কিছুই নেই। 


সবকিছু বুঝে গিয়ে একদিন পরিবারকে বললাম,  

– "তোমরা হয়তো ভাবো বিদেশে টাকা রাস্তায় পড়ে থাকে। কিন্তু এটা বিশ্বাস করো, প্রবাসে টাকা ইনকাম করা কতটা কঠিন, সেটা প্রবাসী ছাড়া কেউ বুঝবে না। তোমাদের জন্য এতকিছু করেও মন পেলাম না। জীবনে আর এই দেশে পা রাখবো না। মরলে লাশও যেন বিদেশেই থাকে।"


পরম শিক্ষা:  

জীবনকে নিজের মতো করে সাজানোই শ্রেয়। বাবা-মা ও পরিবার প্রাধান্য পেলেও, পরিশ্রম ও ত্যাগ সাধ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। অর্থ, খ্যাতি, সম্পদের মোহ জীবন নয়।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url